Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নীল আর নীলকষ্ট নয়...

ইতিহাস বলে বাঙালিদের প্রধান ফসলই ছিল ধান আর পাট। নীল চাষ তারা কখনও করেনি, করার দরকারও পড়েনি। কারণ এর ব্যবহারিক প্রয়োজন তাদের খুব বেশি ছিল না। কিন্তু সে সময় পৃথিবীর অন্যত্র নীলের চাহিদা ছিল ব্যাপক। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে নীল রঙ প্রস্তুত হলেও এটি আবিষ্কারের আগে গাছ থেকে নীল সংগ্রহ করা হতো। ভারতবর্ষের মাটি উর্বর থাকায় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে নীল চাষ করাত। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতের শাসন ক্ষমতা ইংরেজরা গ্রহণ করলে ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ কোম্পানি সবাইকে নীল চাষ করার এলান জারি করে। এ এলান জারির অধিকার পেয়েও ভারতীয়রা নীল চাষে তেমন আগ্রহী হয়নি। সে সময় শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ব্যবসায়ীরা অনেকে বঙ্গদেশ ও বিহারের নীল চাষিদের দিয়ে জোর করে নীল চাষ করিয়ে বিদেশে রফতানি করত। এতে লাভ ছিল ব্যাপক। কালক্রমে নীল ব্যবসায়ী ইংরেজরা গ্রামে কুঠি স্থাপন করে নীল চাষ তদারকি করত। সে কুঠিই নীলকুঠি নামে এখনও বাংলার আনাচে কানাচে কষ্টস্মৃতির মিনার হিসেবে ইতিহাসের নীরব কান্না বহন করছে। নীল চাষ করে কোথাও কোথাও তারা এত অর্থ ও প্রতিপত্তি সম্পন্ন হয়ে ওঠে যে, স্থানীয় জমিদারদের জমিদারি পর্যন্ত তারা কিনে নেয়। এরপর অনিচ্ছুক চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করে, ভালো উর্বর জমিতে নীল চাষ করার জন্য জবরদস্তি করে খুঁটি পুঁতে আসে, এমন কি নীল সংগ্রহ ও কেনার সময় সব অর্থ পরিশোধও করত না। উপরন্তু তারা তাদের পেয়াদা ও লাঠিয়ালদের দিয়ে দৈহিক নির্মম নির্যাতন করা হতো গরিব চাষিদের। এ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ই নীলকর নামে পরিচিত, যাদের অত্যাচারে বহু বিত্তশালী গৃহস্থ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে, অনেক স্থানীয় যুবতী তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, বহু প্রতিবাদী মানুষ জীবন হারিয়েছে।
 
১৮৪৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে নীলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও চাষি ও কৃষক ন্যায্যমূল্য পেতো না। কারণ তাদের ক্রেতা ছিল একমাত্র নীলকর ইংরেজ। এ সময় ভাটির বাংলার প্রায় অর্ধেক নীল উৎপাদিত হতো বঙ্গদেশের নদীয়া ও যশোর জেলায়। প্রাণভয়ে কৃষক নীল চাষ করত কিন্তু তাতে অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় তাদের তৎকালীন ৭ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া কুঠির কর্মচারী, নীলকরদের সঙ্গে বিক্রির মধ্যস্থতাকারী চামচাদের ঘুষ ছিল অতিরিক্ত সাধ্যাতিত। আর যদি মামলায় পড়ে যেত তবে আর রক্ষে নেই আরও বড় অঙ্কের খরচ হয়রানি কষ্টযন্ত্রণা। ব্রিটিশ বেনিয়ারা আমাদের কৃষক তাদের আবাদি ফসল ফলানো বাদ রেখে নিজেদের লাভের জন্য সুন্দর চাকচিক্যের বিলাসিতার জন্য জোর করে নীল চাষ করাত। নীল চাষ না করলে তাদের কঠিন কঠোর অত্যাচার আর অমানসিক নির্যাতন করত। সে কষ্টের ইতিহাস এখনও বয়ে বেড়ায় বাংলার কিছু মানুষ মননে মেধায় স্মৃতিতে বৃতিতে।
 
যদিও দেশের কোথাও আজ নীলকর সাহেবদের পাওয়া যাবে না, তথাপি রংপুর জেলায় বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষের দেখা পাওয়া যায় ভিন্ন আঙ্গিকে। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পরও বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় চাষ হয়ে আসছে নীল। অনুর্বর জমিকে উর্বর করতে ও জ্বালানি সংস্থান আর জৈবসার তৈরির জন্য স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘মাল’ গাছ বালুময় অনুর্বর পতিত জমি যেখানে সাধারণত কোন ফসল হতে চায় না এবং রাস্তার ধারের ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়। অনেকটা রাস্তার পাশের অড়হর গাছ লাগানোর মতো। এ মাল গাছই যে নীলের গাছ তা অনেকেই জানতও না। প্রায় ১৫০ বছরের কষ্টের পরিক্রমা। ১৮৫৯ সনে নীল চাষিদের বিদ্রোহ এখনও জগৎ নাড়া দেয়ার মতো অনুভূতি জাগায় আজো প্রাণের অলিন্দে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্টগাথা নিয়ে কত কাব্যকথা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৫ সন সর্বপ্রথম জানা যায়, এ গাছ থেকে প্রাকৃতিক নীল সংগ্রহ করা যায়। আর আধাবাণিজ্যিকভাবে নীল উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সনে রংপুর সদরের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামের ডা. অনীল কুমার রায়ের ছেলে ডা. নিখিল চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। রংপুর জেলার সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও নীলফামারী জেলা কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ হাজার কৃষক নীল চাষ করছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। ৩/৪ বছর আগেও প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হতো। মাঝে নীল উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ থাকায় এর আবাদ কমে যায়। বন্ধ কারখানা চালু হওয়ায় এখন নীল চাষে নতুন উদ্যোম সৃষ্টি ও গতি সঞ্চার হয়েছে।
 
কথায় বলে জাত মাছে পাদরি ধরে, ভাত মাছে নীল বাঁদরে। বড় কষ্ট নিয়ে ছড়াটা বানিয়েছিল নীল চাষিরা। এ ছড়া শোনানো সে দীনবন্ধু মিত্রও আর নেই, নেই নীল বাঁদরেরাও। ভারতজুড়ে চাষিদের বিদ্রোহের মুখে নীলকর সাহেবের ল্যাজ গুটিয়েছিল প্রায় ১৫০ বছর আগে। এরপর ধীরে ধীরে ইতিহাসের ঘৃণিত অংশ হয়ে গেছে খোদ ব্রিটিশ শাসকেরাই। ধুলোর নিচে চাপা পড়ে গেছে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। স্মৃতির চাদরের ভাজে ভাজে জমা হয়েছে কষ্টকথা। বাংলা থেকে নীল চাষও কি হারিয়ে গেছে? না আবার ফিরে এসেছে নীল, নীল, নীল চাষ। আবার বাংলাদেশের জমিতে নীলগাছ লক লক করে উঠে জানান দিচ্ছে নীল আছে আজো। কিন্তু এবার আর এ চাষের পেছনে হাত নেই নীল বাঁদরদের। এবার আর কারও পিঠে শ্যামচাঁদের বাড়ি দিয়ে চাষ করানো হচ্ছে না। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গে আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে নীল চাষ। ক’বছর আগে শুরু হওয়া নীল চাষ নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে গরিব কৃষককে। এরাই নীলগাছের নাম দিয়েছে মাল গাছ। সারা পৃথিবীতেই এখন প্রাকৃতিক রঙের কদর অনেক বেশি। রাসায়নিক রঙের পারিবেশ বিনষ্টকারী প্রভাব সম্পর্কে পরিবেশবিদেরা এখন সরব। ফলে তৈরি হচ্ছে ট্রু বেঙ্গল ইন্ডিগোর মতো প্রাকৃতিক রঙের চাহিদা। জরিপ বলে শুধু ভারতেই প্রতি বছর দরকার হয় ৩০০ মেট্রিক নীলের। সবচেয়ে ভালো নীলের প্রতি কেজি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ২৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে নীলের মূল বেশির ভাগ চাহিদা মিটিয়ে আসছে এল সালভাদর। কিন্তু উত্তরবঙ্গের চাষিরা স্বপ্ন দেখছেন তাদের উৎপাদন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে যাবে দেশের আয় হবে। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে গর্বিত বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন যে কোনো দেশের। রংপুরের সদর উপজেলা, পাগলান্দীর, কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকার ব্যাপক এলাকায় কৃষক আগে থেকেই মাল বা নীলের চাষ করতেন। উদ্দেশ্য রঙ তৈরি নয়। জমিতে উর্বরতা বাড়ানো আর গাছগুলো শুকিয়ে জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর জন্য। ক’বছর আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এমসিসির উদ্যোগে রঙ তৈরির জন্য নীল চাষ শুরু হয়। বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। রংপুরে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কেজির বেশি প্রাকৃতিক নীল উৎপাদিত হচ্ছে যা দেশে চাহিদার বড় অংশ পূরণের পর বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে আবার ফিরে আসা নীল চাষ এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে হতদরিদ্র মঞ্জুরানী, বিমলা, কৃষ্ণা, মিথিলা, রাখাল, তৈমুর, মেহেদী, আরজু বা বুলু মিয়ার মতো লোকদের। এ মানুষই আগে জুলাই-আগস্টে মঙ্গার প্রস্তুতি নিতেন কষ্টজাগানিয়া রাত পোহানোর জন্য। আর সে সময়ের কষ্টের রাত পোহানোর পর এখন এ এলাকার মানুষগুলো ব্যস্ত নিজেদের নীল উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানোর কাজে।
 
তাদের মধ্যে কেউ নীলগাছ চাষ করছেন কেউ পাতা সংগ্রহ করছেন আবার কেউ ব্যস্ত সে পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণে। লাভ শুধু নীল উৎপাদন করেই নয় কেন্দ্র থেকে যে নাইট্রোজেন ভরপুর বর্জ্য বেরিয়ে আসছে তা আবার ড্রামে ড্রামে চলে যাচ্ছে ফসলের মাঠে সোনালি ফসলের বাহারি ফলনের জন্য। কৃষক তা ব্যবহার করছে ইউরিয়া সারের বিকল্প পরিবেশবান্ধব জৈবসার হিসেবে। জমির মালিকেরা খুশি, চাষি খুশি, খুশি সবাই। খুশি নিজেদের তৈরি রঙ দিয়ে কাপড় রাঙানোয় যারা ব্যস্ত তারাও। রঙিন সে কাপড় চলে যাচ্ছে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বহুমাত্রিক কাজের জন্য। তৈরি হচ্ছে কাঁথা, শাল ও স্কার্ফ। ইতিহাসের কী অপূর্ব পরিহাস এবং তার উল্লেখযোগ্য পুনরাবৃত্তি। যে নীল একদিন তাদের পেটের ভাত কেড়ে নিয়েছিল আজ সে নীল ফিরে এসেছে মঙ্গা তাড়িয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ সুখের নহর বইয়ে দিতে।
 
নীলে বহুমাত্রিক ব্যবহার : নীল সাধারণত সব ধরনের সুতি উলেন সিল্ক টাইপের জামা কাপড়ের রঙ উজ্জ্বল ঝকঝকে চকচকে করার জন্য ব্যবহার করা হয়। একজোড়া জামাকাপড় নীল দিতে ৩ থেকে ৭ গ্রাম নীলের প্রয়োজন হয়। সাধারণ হিসাবে জানা যায়, বছরে ২ মিলিয়ন কিলোগ্রাম নীল উৎপাদিত হয়। দেশের যে কোনো অনাবাদি পতিত জমিতে অনায়াসে নীল চাষ করা যায়। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনাবাদি পতিত অনুর্বর জমি পরিকল্পিতভাবে নীল চাষের আওতায় আনতে পারলে অভাবনীয় সফলতা আসতে পারে ঐতিহাসিক এ নীল চাষে আমাদের কৃষির বিশেষ সমৃদ্ধিতে। নীলের ব্যবহার শুধু নীল হিসেবেই নয়। নীলগাছ উৎকৃষ্ট জ্বালানি এবং জৈবসার। তাছাড়া নীল দেয়া জামা কাপড় পরলে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থেকে শরীরমুক্ত রাখা যায় এবং এলার্জি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নীল চাষে পতিত অনাবাদি অনুর্বর জমি অর্থনৈতিক মূল্যে ব্যবহার করা যায়। নতুন ও বিশেষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, উত্তরাঞ্চলের ফসলভিত্তিক সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নীল তামাকের সুবিকল্প প্রতিযোগিতামূলক ফসল হিসেবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। নীল তেল ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়াজনিত সমস্যা থেকে শতভাগ রক্ষ পাওয়া যায়। ১ দিনের শিশু থেকে শতায়ু বছরের বয়স্কদের শরীরে অনায়াসে নীলতেল ব্যবহার করে শরীর ভালো রাখে। ডাইং ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে বেশ আবশ্যকীয় উপকরণ হিসেবে নীল ব্যবহার আবশ্যকীয় অংশ। ইদানীং চুলে কলপ দেয়ার জন্য বেশ আয়েশিভাবে ব্যবহার বাড়ছে নীলের। নীল ব্যবহারে চামড়া ভালো থাকে, শরীরের উজ্জ্বলতা বাড়ে। নীল তেলের খৈল লোসন হিসেবে, সেভিং ফোম হিসেবে ব্যবহার দীর্ঘদিনের। দেহের ব্যথা উপশমে নীল ব্যবহৃত হয়। কেনিয়ার জনগণ নীলের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন দাঁতের রোগ থেকে উপশম পাওয়ার জন্য। কেউ কেউ পোকার আক্রমণ ও সাপের কামড়ে ব্যথায় বিষ কমানোর জন্য নীল ব্যবহার করেন। নীলের ওষুধ শিল্পে ব্যবহার রয়েছে বহুমাত্রিক। নীল গাছে কোনো সার দিতে হয় না। পোকা রোগে আক্রমণ তেমন করে না। বলতে গেলে কোনো যতœআত্তি করতে হয় না। গরু ছাগল হাঁস-মুরগি খায় না নষ্ট করে না। নীলের পরাগ রেণু মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে শারীরিক গঠনে সহায়তা করে। নীল তামাকের শতভাগ বিকল্প চাষ হতে পারে লাভ, পরিবেশ আর সার্বিকতা চিন্তা করে।
 
নীলগাছের পরিচিতি : নীল (Indigoferra sp.) কে প্রাকৃতিক নীলও বলা হয়। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে নীল সাধারণত মৌসুমি গাছ ৬ মাসের জীবনকাল বিশিষ্ট বৃক্ষ নয় তবে আধা শক্ত গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে বীজ বপন করলে অক্টোবর নভেম্বরে গাছ মারা যায়। বর্ষায় পাতা ঝরে যায়। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা ঝোপালো গাছ হয়। পাতা ওভাল গোল ও সমান্তরালভাবে সন্নিবেশিত। ফুল গোলাপি থেকে বেগুনি রঙের হয়। মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়াতে এটা আচ্ছাদন ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। অনুর্বর জমিতে অনাদরেই বেড়ে ওঠে নীল কষ্টের নীলকণ্ঠ। নীলের অন্তত ৭৫০টি প্রজাতি আছে বিশ্বময়। নীলগাছ উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলে বেশি জন্মে। তবে বেশি প্রচলিত জাত হলো Indigofera আর এরা Fabaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত উদ্ভিদ। বিভিন্ন রকমের ফুল হয়। তবে লাল রঙের একটু ছায়া থাকে লালচে। তবে কিছু কিছু জাতের ফুল সাদা ও হলুদ রঙের। ফল ও বীজ সরিষার মতো। তবে জাতভেদে বিভিন্ন আকারের হয়। নীল বানানোর জন্য দুটো জাত বেশি উপযোগী। এ দুটো জাত হলো Indigofera tinctoria এবং Indigofera suffruticosa| পৃথিবীর কোনো কোন দেশে নীল তাদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত। নীল বা Indigo কে বলা হয় The color of Kings।
 
বীজ বপন : ফেব্রুয়ারি-মার্চ মূলত বীজ বপনের মূল সময়। অর্থাৎ আমাদের দেশে যখন পাট বপন করে তখনই নীলের বীজ বোনার সময় হয়। এক চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনা চাষেই বীজ বপন করা হয়। প্রতি একরে ৪-৫ কেজি আর হেক্টরে ১০-১৫ কেজির বীজের প্রয়োজন হয়। নীলের বীজ অনেকটা সরিষার বীজের মতো। ছিটিয়ে বপন করা হয় অনেকটা ধইঞ্চা বা পাটের বীজে মতো।
 
পাতা কাটা ও প্রক্রিয়জাতকরণ : বীজ বপনের ৯০ দিন পর গাছ যখন একটু বড় হয় তখন প্রথমবার পাতা কাটা হয়। ওপর থেকে ১ দেড় ফুট শাখাসহ পাতা কেটে আনা হয়। এভাবে ১ বার কাটার পর ৬ মাস আয়ুকাল মৌসুমে অন্তত ৪-৫ বার পাতা কাটা যায়। পাতা সংগ্রহের পরও গাছের অবশিষ্ট অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বীজের গাছ থেকে নিয়মিত পাতা সংগ্রহ করা হয় না। প্রথমবার পাতা কাটার পর বীজ গাছকে আলাদা করে যত্নআত্তি করে রাখা হয় বীজ সংগ্রহের জন্য। নীল সংগ্রহ কোনো বিশেষায়িত পদ্ধতি নয়। জমি থেকে গাছের উপরের শাখাসহ নীল পাতা সংগ্রহ করে চৌবাচ্চাতে পরিমাণমতো পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় বা জাগ দেয়া হয়। পানি এ পরিমাণে হবে যেন পাতার উপর ১ ইঞ্চি পানি থাকে। এভাবে ২০ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা জাগে ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রথম চৌবাচ্চা থেকে পাতা ডালপালা ছেকে শুধু নীল পানি দ্বিতীয় চৌবাচ্চােেত নেয়া হয়। পাতা ডালপালা জৈবসার কিংবা জ্বালানি হিসেবে শুকিয়ে নেয়া হয় বা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় চৌবাচ্চা থেকে ১ ঘণ্টা ঝাঁকানির পর প্রচুর ফেনা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অটোমেটিক পদ্ধতিতে পানি নাড়াচাড়া করা হচ্ছে। এরপর পরিমাণমতো কস্টিক সোডা (গোপন ফরমুলা) মিশিয়ে আবার অনবরত নাড়াচাড়া বা ঝাঁকানো হয়। কতক্ষণ পর পুরো দ্রবণকে মাঝারি আকারের ঝুড়ি নিয়ে তারমধ্যে মোটা মার্কিন কাপড় বিছিয়ে দিয়ে ছাকার জন্য ফেনাযুক্ত ঝাঁকানো দ্রবণ ঢালা হয় এবং ১ দিনের জন্য রেখে দেয়া হয়। এতে মার্কিন কাপড়ে তলানি জমা হয় আর থিতানো পানি আলাদা হয়ে যায়। মার্কিন কাপড়ের এ তলানিই নীল। ছাকা পানি গাছের গোড়ায় দেয়া হয় বা বাথরুম মেঝে পরিষ্কার করতে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। এ পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে পা ফাটা বা পায়ের বিভিন্ন চর্মরোগ সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়। পানি ঝরে যাওয়ার পর মার্কিন কাপড় থেকে ছোট চামচের মাধ্যমে কাঁচিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এ সেমিসলিড ভেজা শক্ত অংশ নীল রোদে শুকিয়ে দানাদার নীল তৈরি হয়। প্রথমে রোদে শুকালে নরম কয়লার মতো হয়। ১-২ দিন শুকালেই নীল শক্ত হয়। পরে গ্রাইন্ডিং মেশিনে বা হলারে বা পাটাপুতাতে পিশে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। সাধারণভাবে প্রতি প্যাকেট নীলের দাম আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে কৌশল আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে এ দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, লাভও বেশি হবে। অনেক সময় ছোট ছোট আস্ত টুকরা করে ৫ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
 
প্রতিবারে প্রতি শতক জমি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি পাতা সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ১ একর জমি থেকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি পাতা কাটা যায়। প্রতি কেজি পাতা মূল্য ২ থেকে ৩ টাকা হারে বিক্রি হয়। প্রতি একর থেকে ৫০ হাজার টাকার শুধু নীলপাতা বিক্রি করা যায়। তাছাড়া জ্বালানি এবং জৈবসার তো আছেই। এ পদ্ধতিতে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পাতা থেকে ১ কেজি নীল পাওয়া যায়। ১ কেজি নীল পেতে ১ হাজার টাকা খরচ হয়। বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি প্রাকৃতিক নীল প্রায় ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ মানসম্মত হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের সংগ্রহ পদ্ধতিতে প্রায় ১০ ভাগ নীল পাওয়া যায়। এ কারণে অনেক দেশে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রফতানি করা যাচ্ছে না। নীলের বীজ থেকে নীল তেল তৈরি করা যায়। ১০ মিলিলিটার তেল ৩০ মার্কিন ডলার। ৫ কেজি বীজ থেকে ১ কেজি তেল পাওয়া যায়। বীজের মূল্য ১৫০ টাকা ২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি। নীল চাষে আর উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। কেননা এটা অনুর্বর জমিতে আবাদ করা হয় জমি উর্বর করার জন্য। তাই কোনো সার পানি বালাইনাশক দেয়ার দরকার হয় না। শুধু শ্রমিক মজুরি লাগে। সর্বসাকুল্যে ১ একরে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়।
 
ডা. নিখিলের নীল চাষে বর্তমান প্রতিশ্রুত সমৃদ্ধির অগ্রপথিক। একা একাই এগোনোর চেষ্টা করছেন। তাকে যথাযথ সহযোগিতা করতে পারলে আমরা নীল নিয়ে আরো অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারতাম। Mennonite Central Committee (MCC) এ থেকে তিনি নীলে কারিশমা আয়ত্ব করেন।  তিনি মনে করেন নীলে এত বৈশিষ্ট্যের কার্যকারিতার পরেও নীলগাছ দিয়ে জাক দেয়ার পর বাছাই করা ডালপালা থেকে উৎকৃষ্ট মানের কম্পোস্ট সার তৈরি; পাতা সংগ্রহের পর গাছের অবশিষ্টাংশ থেকে কয়েল তৈরি এবং নিজের তৈরি বন্ধু চুলাতে ব্যবহার; ছাকনির সময় ফেলে দেয়া পানি মিনি প্যাকেটজাত করে ক্লিনার লিকুইড হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যায়। নীল আমাদের ঐতিহাসিকভাবে নীলকণ্ঠ নীলকষ্ট অনেক কষ্টগাথা কথা। কিন্তু রংপুরের ডা. নিখিল এ কষ্টগাঁথাকে সুখ গাঁথায় পরিণত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুটা এগোতে পেরেছেনও। তবে এগোনোর অনেক বাকি এখনও। ডা. নিখিল বলেন, সরকার যদি আমাকে পতিত অনাবাদি অনুর্বর জমি দেয় আর আমাকে ৪-৫ কোটি টাকার  ঋণ দেয় তাহলে আমি আমার নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে আধুনিক মেশিন তৈরি করে আরও বেশি পরিমাণে আন্তর্জাতিক মানসম্মত নীল তৈরি করে বিদেশে রফতানি করতে পারব, আত্মকর্মসংস্থানে অনেক বেকার যুবক-যুবতীকে কাজের সংস্থান সৃষ্টি করতে পারব। মাত্র ১ ঘণ্টা পুরো ২ দিনের কাজ করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় কথা দেশে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি আরও বেগবান করা যাবে অনায়াসে। যারা বিত্তশালী চিত্তশালী তারা এগিয়ে আসবেন এ সুন্দর কাজে। ডা. নিখিলের মতো আগ্রহী অভিজ্ঞ দক্ষ মানুষগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা আয় করবেন আবার দেশের অভাবনীয় সফলতায় শরিক হবেন এটা তো কম কথা নয়। ৫০ হেক্টর জমির বর্তমান নীল চাষকে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে রূপান্তর করা কোনো ব্যাপারই না। শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর তার কার্যকর বাস্তবায়ন। শেষ করার আগে নীল কবিতা দিয়ে কিছু কষ্টগাথা তুলে ধরা হলো এভাবে...
নীলকর বিষধর বিষফোড়া মুখ, অনল শিখায় ফেলে দিল যত সুখ।
অবিচারে কারাগারে পিতার নিধন, নীলক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হলেন পতন।
পতিপুত্র  শোকে মাতা হয়ে পাগলিনী, স্বহস্তে করেন বধ সরলা কামিনী।
আমার বিলাপে মার জ্ঞানের সঞ্চার, একেবারে উথলিল দুঃখ পারাবার।
শোকশূলে মাথা হলো বিষ বিড়ম্বনা, তখনি মলেন মাথা কে শোনে সান্ত¡না।
কোথা পিতা কোথা পিতা ডাকি অনিবার, হাস্যমুখে আলিঙ্গন কর একবার।
জননী জননী বলে চারি দিকে চাই, আনন্দময়ীর মূর্তি দেখিতে না পাই।
মা বলে ডাকিলে মাতা অমনি আসিয়ে, বাছা বলে কাছে লন মুখ মুছাইয়ে।
অপার জননী স্নেহ কে জানে মহিমা, রণে বনে ভীতমনে বলি মা, মা, মা, মা।
সুখাবহ সহোদর জীবনের ভাই, পৃথিবীতে হেন বন্ধু আর দুটি নাই।
নয়ন মেলিয়া দাদা দেখ একবার, বাড়ি আসিয়াছে বিন্দুমাধব তোমার।
আহা! আহা! মরি মরি বুক ফেটে যায়, প্রাণের সরলা মম লুকালো কোথায়।
রূপবতী গুণবতী পতিপরায়ণা, মরালগমনা কান্তা কুরঙ্গনয়না।
সহাস বদনে সতী সুমধুর স্বরে, বেতাল করিতে পাঠ মম করে ধরে।
অমৃত পঠনে মন হতো বিমোহিত, বিজন বিপিনে বনবিহঙ্গ সঙ্গীত।
সরলা সরোজকান্তি কিবা মনোহর, আলো করে ছিল মম দেহ সরোবর।
কে হরিল সরোরূহ হইয়া নির্দয়, শোভাহীন সরোবর অন্ধকারময়।
হেরি সব শবময় শ্মশান সংসার, পিতামাতা ভ্রাতা দারা মরেছে আমার।
 
অনুর্বর ও অনিশ্চিত জমিতে ধান বা তামাক লাগিয়ে যে সামান্য শস্য ও আয় হতো তাই ছিল গরিব চাষিদের বাঁচার উপায়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর প্রশাসন অনেক নীলকর সাহেবকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করে বিদ্রোহী ভারতীয়দের দমন করার জন্য। এ ক্ষমতার ব্যবহার হয় গরিব চাষিদের ওপর, নীলচাষে বাধ্য করত। অর্থনৈতিক ও শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য বাংলার চাষি ও কৃষকরা ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট সেপ্টেম্বর মাস হতে ব্যাপকভাবে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। যশোর জেলার চৌগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে হাজার হাজার চাষি এ বিদ্রোহে অংশ নেয়। ঝিনাইদহ জেলার ষোলোকুপাতেই এখন যার নাম শৈলকুপা ৬ হাজার চাষি নীলকর লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। সারা বাংলায় ব্যাপ্ত এ বিদ্রোহই নীল বিদ্রোহ নামে ইতিহাস খ্যাত। নীলকরদের অত্যাচারের কথা এর আগেই প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে Indigo Commission গঠিত হয়। কিন্তু এ কমিশনের তদন্ত ও ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান করতে না পারায় নীল বিদ্রোহ ঘটে। নীল দর্পণে এ অগ্নিগর্ভ সময়ের ঘটনা নাটকীয় ফরমেটে উল্লেখ আছে। পরে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে নীলচুক্তি আইন রদ হয় এবং ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নীল উৎপন্ন আরম্ভ হলে নীল অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ হলো আমাদের নীল কষ্টের কষ্টগাথা। বর্তমানে ইতিহাসের পরের ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন প্রবাহে আমাদের প্রবৃদ্ধির মহিমায় উদ্ভাসিত। ইতিহাসের এ অধ্যায় ধরে আমরা এগোবো আগামীর সুন্দর আর মহাজাগতিক কল্যাণের দিকে। নীল চাষ সুবাসিত সীমাহীন নীলাকাশের মতো বিশালতায় আমাদের অনেক দূরের নীলাভ প্রশান্তির পরিসীমানায় নিয়ে যাবে। এ নীলাশা করতেই পারি।
 
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
 

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon